আলোকিত বাংলা রিপোর্ট || ঢাকাই চলচ্চিত্র সোনালী ঐতিহ্য হারিয়েছে- কথাটি সবিই বলেন। চলচ্চিত্র-খড়ায় ১২০০ সিনেমা হল থেকে কমতে কমতে ৫০-এর কোটায় নেমেছে এর সংখ্যা। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরের সিনেমা শিল্পে ধস নেমেছে বলা যায়। করোনার চোখ রাঙানি কিছুটা স্বাভাবিক হলে প্রেক্ষাগৃহে বেশ কিছু নতুন সিনেমা মুক্তি পায়। তবে সিনেমাগুলো প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। এবার ঢাকাই চলচ্চিত্র পুনর্জাগরণে আশা জাগিয়েছে ঈদের সিনেমা। তবে এ ভালোর মধ্যেও রয়েছে একটু কালো।
স্বাভাবিকভাবে ঈদের সিনেমা মুক্তি নিয়ে মাসখানেক আগেই তোড়জোড় শুরু হয়। এবারো হয়েছে, তবে সেটা ছিল সুস্থ তোড়জোড়। অন্যান্য সময় ঈদের সিনেমা বেশি প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া নিয়ে সিনেমার প্রযোজকরা বুকিং এজেন্টদের সঙ্গে নানা আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা করে, তা নিয়ে দেনদরবার করার পাশাপশি পেশীশক্তি প্রদর্শনও হয়। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়ার জন্য হল মালিকদের রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় ক্যাডারদের দিয়ে চাপ সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায় বিভিন্ন সময়। তবে এবার এমন অভিযোগ শোনা যায়নি। এটা চলচ্চিত্রের জন্য অবশ্যই ভলো দিক।
এবারের সিনেমা মুক্তির পর পাল্টে গেল সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহের চিত্র। দেশজুড়ে ১৬৩টি প্রেক্ষাগৃহে এবার মুক্তি পেয়েছে চারটি সিনেমা। ঈদ উপলক্ষে এবার নতুন করে ৯৩টি প্রেক্ষাগৃহ খুলেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে শাকিব খান অভিনীত ‘বিদ্রোহী’ মুক্তি পায় ১০০টি প্রেক্ষাগৃহে। এই নায়কের অন্য সিনেমা ‘গলুই’ মুক্তি পায় ২৮টিতে। সিয়াম আহমেদ-পূজা চেরি জুটির তৃতীয় সিনেমা ‘শান’ দেখা যাচ্ছে ৩৪টি প্রেক্ষাগৃহে। এ ছাড়া ‘বড্ড ভালোবাসি’ নামের সিনেমাটি মুক্তি পায় ব্লকবাস্টারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো দেখতে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ঈদের দিন বৃষ্টির কারণে প্রথম শোতে তেমন একটা দর্শক না এলেও পরের শোগুলোতে ছিল দর্শকের সরব উপস্থিতি। ক্রমেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরছেন। বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে দেখা গেছে সর্বাধিক দর্শক সমাগম। ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে একাধিক শো ছিল হাউস ফুল।
অনেকের ধারণা ছিল, সিনেমা যেমনই হোক দর্শক আর ঘর থেকে বেরিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাবে না। কিন্তু ঈদের সিনেমাগুলো প্রমাণ করেছে, সে ধারণা সঠিক নয়। ঈদের সিনেমা দিয়ে জমজমাট সিনেমাপাড়া। এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। এটাই এবারের ঈদে নির্মাতাদের বড় অর্জন। প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘গলুই’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’ তিনটি সিনেমাই ভালো ব্যবসা করছে। এ সিনেমাগুলোর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর দর্শক আবারও প্রেক্ষাগৃহে আসছেন। এটি বাংলা সিনেমার জন্য ইতিবাচক। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি খুব শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে।’
এদিকে সিনেমা নিয়ে দর্শক রেসপন্স প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও পজিটিভ রিভিউ দিয়েছেন অনেকেই। এতসব ভালো মধ্যে রয়েছে একটু কালো। সিনেমা হলেও পাশাপাশি অডিটোরিয়ামে প্রদর্শন করছিল ‘গলুই’। পাঁচদিনের মাথায় স্থানীয় প্রশাসন তা বন্ধ করে দেয়। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ ও ক্ষোভ ঝাড়ে চচ্চিত্রের অনেকেই। তবে এখন প্রদর্শনের বাধা নেই বলে জানা যায়। এসব বিষয় নিয়েও চলচ্চিত্রে সিনেমা পাড়ায় গ্রুপিং। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন এটাও কারো ইশারায় হয়েছে।
চলচ্চিত্রে দুই ভাগে বিভক্ত তা প্রকাশ পেয়েছে আগেই। বিশেষ করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে কাঁদা ছোড়াঁছুড়িতে কারো চেয়ে কেউ কম করেনি। সেই প্রভাব এখনও বইছে সিনেমা পাড়ায়। এর রেষ কাটতে না কাটতেই আগামী ২১ মে বাংলাদেশ প্রযোজক পরিবেশক সমিতির নির্বাচন। এ নিয়েও গ্রুপিং কম নয়। এই নির্বাচনে শাপলা মিডিয়ার কর্নধার সেলিমের নেতৃত্বে একটি প্যানেল ও খোরশেদ আলম খসরু নেতৃত্বে একটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। এবারের ঈদে সেলিম খান প্রযোজিত ‘বিদ্রোহী’ ও খোরশেদ আলম খসরু প্রযোজিত ‘গলুই’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্র পাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায় দুই পক্ষের অনুসারীরা চায়ের আড্ডায় অপর পক্ষের সিনেমার নেগেটিভ মন্তব্য করছেন। নির্মাতাদের তুলোধুনো করতে ছাড়ছেন না তারা। এতে করে প্রভাব পরছে পুরো ইন্ডাস্ট্রির উপর। প্রতিপক্ষের সিনেমাকে ফ্লপ বানাতে গিয়ে চলচ্চিত্রের ক্ষতি হচ্ছে। তাদের এই রেষারেশি সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত গাড়ায়।
ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতির বড় সমস্যা গ্রুপিং। গ্রুপিংয়ের কারণে নিজেদের সিনেমা নিজেরাই পাবলিকলি খারাপ করছেন। তারা চাইলেই পারেন নিজেদের সিনেমার প্রমোট করে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে ফেরাতে। তবে চলচ্চিত্রের কিছুসংখ্যক লোক সকল সিনেমার প্রমোশন নিজ দায়িত্বে করেন। যদিও চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেল তাদের ইসতেহারে বলেছিলেন-সিনেমার প্রমোশনে তাদের কমিটি কাজ করবে। এবারের ঈদে তাদের ঈদ শুভেচ্ছা কার্ডে মুক্তি পাওয়া তিনটি সিনেমার নাম ছিল।
এত কিছুর পরও এবারের ঈদের সিনেমা সগৌরবে চলছে। চলচ্চিত্রের কল্যাণের জন্যই সংগঠন-নেতৃত্ব। নির্বাচন হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। নেতৃত্বকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে সিনেমা শিল্পের ক্ষতি করে এই নেতৃত্বের লাভ কি? অসুস্থ এই প্রতিযোগিতাকে পাশে রেখে ঈদের সিনেমার যতটুকু সফলতা আছে তা আগামী ঈদুল আজহা পর্যন্ত টেনে নিতে পারলে ঢাকাই চলচ্চিত্র পুনর্জাগরণের পথ সুগম হবে।